হযরত আবূ হুরায়রা (রদি.)

সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি উম্মাতের কাছে হাদীস পৌঁছানোর গৌরব অর্জন করেছেন তিনি হলেন হযরত আবূ হুরায়রা (রদি.)। তাঁর থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫৩৭৪ টি।

তিনি মূলত ইয়েমেনের দাউস গোত্রের ছিলেন। সেখানে তিনি ছাগল চড়াতেন। ইয়েমেনে যখন ইসলাম পৌঁছল তখন বিভিন্ন গোত্রের লোকজন ইসলাম শেখার জন্য দলে দলে মদীনায় আসতে থাকল। তিনিও তাঁর গোত্রের সাথে ৭ম হিজরীতে খাইবার যুদ্ধের স্থানে নবীজীর খেদমতে হাজির হলেন এবং নবীজীর হাদীস সংরক্ষণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে মদীনাতেই থেকে গেলেন। সেসময় তাঁর বয়স হয়েছিল ত্রিশের কিছু বেশি। তিনি ছিলেন গৌরবর্ণ, প্রশস্ত বক্ষ, প্রলম্বিত কাঁধ এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। এরপর যখন বয়স্ক হলেন তখন দাড়িতে খেযাব লাগাতেন। স্বভাবগতভাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কোমল, সাদাসিধে এবং খুবই আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন। আসহাবে সুফফার সাথে বসে বসে তিনি হাদীস মুখস্থ করতেন।

 

তিনি তাঁর মায়ের অনেক খেদমত করতেন। মাকে তিনি ইয়েমেন থেকে মদীনায় নিজের কাছে এনে রাখলেন। তখনো তাঁর মা ইসলাম গ্রহণ করেন নি। তাই তিনি মাকে দীনের দাওয়াত দিতেন এবং বোঝাতেন। কিন্তু তাতে খুব বেশি ফায়দা হত না। বারবার অস্বীকার করে যেতেন। একদিন তো তাঁর মা তাকে খুব শক্ত ভাষায় অনেক কথাও বলে দিলেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে রসূল (স.)-এর দরবারে গিয়ে মায়ের হেদায়তের জন্য দুআ চাইলেন। সাথে সাথে নবীজীর হাত আকাশের দিকে উঠে গেল।

হজরত আবূ হুরায়রা (রদি.) নবীজীর দুআর প্রভাব দেখার জন্য দৌড়ে ঘরে গেলেন। দেখলেন দরজা বন্ধ। তবে ভেতর থেকে গোসলের শব্দ আসছিল। কিছুক্ষণ পর তার মা দরজা খুলে বাইরে এলেন এবং কালিমা পড়ে ইসলাম গ্রহণ করে নিলেন। আর এই কথ বললেন যে, অন্তরে হেদায়তের আলো প্রবেশ করেছে। ইতিহাসে তিনি উম্মে আবূ হুরায়রা, উমাইমা বা মায়মূনা নামে পরিচিত (রদি.) ।

 

হযরত আবূ হুরায়রা (রদি.) ছিলেন সেসব সৌভাগ্যবান সাহাবীর একজন, যারা রসূল (স.) থেকে ইলম অর্জনের জন্য নিজেদের জীবন ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। তাদেরকে ইতিহাসে আসহাবে সুফফা নামে স্মরণ করা হয়। তারা তেমন কোনো আয়-রোজগার করতেন না। বরং ইলমে দীন ও মাসআলা-মাসায়েল শেখার জন্য সবসময় রসূল (স.)-এর দরবারে পড়ে থাকতেন। মদীনাবাসীরা তাদের জন্য মসজিদের একটি খুঁটিতে খেজুর ঝুলিয়ে দিতেন অথবা অন্য কোনো দান-সদকা পাঠাতেন। সেগুলো আসার সাথে সাথে তাদের মাঝে সমানভাবে বণ্টন হয়ে যেত। অনেক সময় আবার না খেয়েই থাকতে হত। ক্ষুধার তীব্রতায় অনেকে তখন মসজিদে নববীতে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রদি.) নিজেই বলেছেন, মাঝে মাঝে আমার এমন অবস্থা হত যে, ক্ষুধার কারণে মসজিদে নববীতে নবীজীর হুজরা ও মিম্বারের মাঝখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতাম।

 

হযরত আবূ হুরায়রা (রদি.)-এর কারণে তাঁর মাও অনেক দরিদ্রতার সাথে জীবনযাপন করেছিলেন। একবার হযরত আবূ হুরায়রা (রদি.) প্রচণ্ড ক্ষুধায় অস্থির হয়ে ছুটে গেলেন আসহাবে সুফফার কাছে কিছু আছে কি না খুঁজতে। কিন্তু গিয়ে দেখলেন তারাও অনাহারে ভুগছে। তখন তিনি নবীজীর কাছে গেলেন এবং এই অবস্থার কথা অবগত করলেন। তখন নবীজী খেজুরভর্তি একটি থালা নিয়ে মসজিদে এসে সকলের মাঝে ভাগ করে দিয়ে বললেন, এগুলো খেয়ে পেট ভরে পানি পান করে নাও। আজকের দিন কেটে যাবে। হযরত আবূ হুরায়রা (রদি.) একটি খেজুর খেলেন এবং আরেকটি রেখে দিলেন। রসূল (স.) এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, এটি আমার মায়ের জন্য রেখে দিয়েছি। রসূল (স.) তখন খুব নম্রতার সাথে বললেন, তুমি এটিও খেয়ে নাও। আর বাড়তি দুটি খেজুর তোমার আম্মার জন্য আমার কাছ থেকে নিয়ে যেয়ো।

 

তখন প্রায় সময়ই রসূল (স.) থেকে মুজিযা প্রকাশ পেত। একবার ক্ষুধার তাড়নায় হযরত আবূ হুরায়রা (রদি.) গেলেন নবীজীর কাছে। নবীজীর ঘরে তখন মাত্র এক পেয়ালা হাদিয়ার দুধ ছিল। নবীজী তাঁকে বললেন, আসহাবে সুফফার সকলকে ডেকে নিয়ে আসো। হযরত আবূ হুরায়রা (রদি.) বলেন, আমি তখন মনে মনে ভাবছিলাম যে, তাদের সকলকে এক পেয়ালা দুধ দেওয়ার পর আমার জন্য আর কীই-বা বাকি থাকবে! যাক, তিনি নবীজীর আদেশমতো আসহাবে সুফফার সকলকে ডেকে আনলেন। রসূল (স.) তখন সকলকে দুধ পান করানোর দায়িত্ব তাকেই দিলেন। তিনি সকলকে পান করালেন। উপস্থিত সকলেই একেবারে পরিতৃপ্ত হয়ে পান করল। কিন্তু আল্লাহ তাআলার কি কুদরত! পাত্রে যতটুকু দুধ ছিল ততটুকুই রয়ে গেল। রসূল (স.) তখন একটু মজাক করে বললেন, আবূ হুরায়রা, এখন তো শুধু তুমি আর আমিই বাকি। এই বলে তিনি পাত্রটি হযরত আবূ হুরায়রার হাতে দিয়ে পান করতে বললেন। তিনি পাত্রটি হাতে নিয়ে পান করতে থাকলেন আর রসূল (স.) বলতে থাকলেন, আবার পান কর, আবার পান কর। একপর্যায়ে হযরত আবূ হুরায়রা বললেন, এর চেয়ে বেশি পান করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এরপর সেই দুধের পেয়ালা নবীজী নিয়ে পান করলেন।

 

বিড়ালের সাথে হযরত আবূ হুরায়রা (রদি.)-এর খুব সখ্য ছিল। ইয়েমেনে তিনি যখন ছাগল চড়াতেন তখন একটি বিড়ালের বাচ্চা খুব আদর করে লালন-পালন করেছিলেন। তিনি সেই বিড়ালের সাথে খেলতেন। কিন্তু তার এই আগ্রহ মদীনাতে আসার পরও রয়ে গিয়েছিল। রসূল (স.) তাকে সে কারণেই আবা হিররা (বিড়ালের বাবা) বলে ডাকতেন। ভালোবাসা-মাখা এই ডাক পরবর্তীতে এমনই প্রচার হয়েছিল যে, তার আসল নামই বিস্মৃত হয়ে গেল এবং আবূ হুরায়রা তার উপনাম হিসেবে লোকমুখে প্রচার হল। এই নামটা তারও অনেক বেশি পছন্দ হয়েছিল। ফলে তিনি খুব খুশির সাথেই মানুষকে বলতেন যে, আমার এই নাম রসূল (স.) রেখেছেন। শতবছর পরের আলেমগণ যখন তার আসল নাম জানতে চাইলেন এবং খোঁজ নিলেন তখন দেখলেন যে, প্রত্যেকের কথা ও মত আলাদা। একপর্যায়ে তার নামের সংখ্যা ৩০ ছাড়াল। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বিশুদ্ধ কথা হল, জাহিলী যুগে তার নাম ছিল আবদে শামস। ইসলাম গ্রহণের পর তার নাম রাখা হয়েছিল আব্দুল্লাহ বা আব্দুর রহমান।

 

তার প্রখর মেধাশক্তিও রসূল (স.)-এর একটি মুজিযা ছিল। একবার তিনি নবীজীকে বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ, আমি আপনার থেকে অনেক হাদীস শুনি কিন্তু তা ভুলে যাই। তখন নবীজী (স.) তাকে বললেন, তোমার চাদর বিছাও। তিনি চাদর বিছালেন। তারপর নবীজী দুহাত অঞ্জলী করে এতে কী যেন রাখলেন (অন্য বর্ণনায় আছে, নবীজী কিছু হাদীস শোনালেন)। এরপর বললেন, এটি তোমার বুকে লাগাও। তিনি তা বুকে লাগালেন। হযরত আবূ হুরায়রা বলেন, এরপর থেকে আমি আর কোনো হাদীস ভুলি নি।

 

আল্লাহ তাআলা তার হাদীসের দারসে অনেক বরকত দান করেন। তার থেকে হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী ও তাবেয়ীর সংখ্যা আটশোর অধিক। সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে অধিক হাদীস তার মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। কেউ যখন তার থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা এতো অধিক পরিমাণ দেখে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করত তখন বলতেন, ′আমাদের মুহাজির ভাইগণ ব্যবসা করতেন এবং আনসার ভাইগণ করতেন চাষাবাদ। আর আবূ হুরায়রা পেটে সয় এমন সামান্য খাবার খেয়ে নবীজীর খেদমতে পড়ে থাকত। তারা যখন উপস্থিত থাকত না তখন উপস্থিত থাকত এবং তারা যা মুখস্থ করে নাই তা মুখস্থ করেছিল।“

 

রাজত্ব ও ক্ষমতার ব্যাপারে তার ভেতর বিন্দুমাত্র লোভ ছিল না। কিন্তু এরপরও হযরত উমর (রদি.)-এর যুগে কিছুদিনের জন্য বাহরাইনের হাকিম ছিলেন। হযরত আলী (রদি.) ও হযরত মুআবিয়া (রদি.)-এর ইখতিলাফের সময় তিনি নিরপেক্ষ অবস্থানে ছিলেন। জীবনের শেষ দিকে মদীনায় তার অবস্থিত ঘরটি তিনি তার আজাদকৃত গোলামদেরকে দান করে দিয়ে শহর থেকে দূরে যুলহুলাইফার এক গ্রামে বসবাস করতে থাকলেন। ৫৯ হিজরীতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতা যখন খুব তীব্র হয়ে গেল তখন তার চোখে পানি দেখে এক ব্যক্তি তার অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইল। তখন তিনি বলেছিলেন, ′তোমাদের এই দুনিয়ায় থাকার জন্য নয়; বরং আমি কাঁদছি আমার সফরের দীর্ঘতা দেখে। অথচ পাথেয় সে অনুপাতে খুব অল্প দেখে। তুমি একটি পাহাড়ের চূড়ায় আছো। আর নীচে এক পাশে আছে জান্নাত আরেক পাশে জাহান্নাম। জানা নেই তুমি জান্নাতে পড়বে নাকি জাহান্নামে।“

এর কিছুদিন পরেই তিনি ৭৮ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। মদীনার হাকিম ওয়ালীদ ইবনে উতবা তার জানাযার নামায পড়ান। এরপর তাকে জান্নাতুল বাকীতে দাফন করা হয়। রদিয়াল্লাহু আনহু ওআরদাহ।

 

 

তথ্যসূত্র :

  • সিয়ারু আলামিন নুবালা : ২/৫৮৬-৫৮৮, ২/৬১০-৬২৬
  • সহীহ মুসলিম : ৬৬৫১
  • আল-ইসাবা : ৮/৩২৭
  • তিরমিযী : ২৩৬৭, ২৪৭৭
  • হিলইয়াতুল আওলিয়া : ১/৩৭৮
  • তবাকাতে ইবনে সাআদ : ৪/৩২৮
  • সহীহ বুখারী : ১১৮, ১১৯, ৬৪৫২
  • আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১১/৩৬২
  • তারিখে উম্মাতে মুসলিমাহ : ২/৬৫১-৬৫৪

 

#সীরাতে সাহাবা

#বালাগুস সুন্নাহ

Copyright বালাগুস সুন্নাহ — Director & Editor : Yasin Arafat Rafi, Developed by Dr. Engr. Muhammad Reazul Haque. All rights reserved.
https://balaghussunnah.com | balaghussunnah@gmail.com